পৃষ্ঠা

লোকের বাড়ি কাজ করে সবজি বিক্রি করে গরীবদের জন্য বানালেন আস্ত একটি দাতব্য হাসপাতাল



hospital



একজন নিরক্ষর মহিলা বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে, পার্ক সার্কাসের ব্রিজের নীচে সব্জি বিক্রি করে, ধাপার মাঠে ময়লা ঘেঁটে কয়লা তুলে বিক্রি করে, তিল তিল করে জমানো টাকা দিয়ে গড়ে তুলেছেন আস্ত একটি হাসপাতাল। যেখানে গরিবদের বিনামূল্যে চিকিৎসা হয়।

১৯ কাঠা জমির উপর ৪৫ শয্যার হাসপাতাল। নাম 'হিউম্যানিটি হসপিটাল, তবে লোকমুখে পরিচিতি 'বুড়িমার হাসপাতাল' নামে। আছেন ২০ জন ডাক্তার (তার মধ্যে ৪ জন স্থায়ী-বেতনভুক , বাকিরা ফ্রিতে চিকিৎসা করেন), ৩২ জন নার্স। এখানে গরিব রোগীদের চিকিৎসার জন্য এক টাকাও লাগে না। বিনা পয়সায় তাঁরা পান ওষুধ। ১০ শয্যার আইসিসিইউ। নিখরচায় ভেন্টিলেশন। আউটডোর ছাড়াও মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, চোখ, ইএনটি, ইউরোলজি, পেডিয়াট্রিক, ইউরোলজি-সহ একাধিক বিভাগ চলে এখানে। অস্ত্রোপচার হয়। হয় প্রায় সব রকম পরীক্ষা।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঠাকুরপুকুর বাজার লাগোয়া হাসপুকুরে অবস্তিত এই বুড়িমার হাসপাতাল । প্রতিষ্ঠাতা সুবাসিনী মিস্ত্রী (বুড়িমা) বয়স বর্তমানে প্রায় ৭৩ বছর, বছর কুড়ি আগেও সুবাসিনীকে মিস্ত্রিকে এলাকার মানুষ চিনতেন ‘সব্জি মাসি’ বলে। তিনিই এখন হাসপুকুরের ‘হাসপাতাল দিদিমা’! কী ভাবে সম্ভব হল এই পরিবর্তন? সবজি বিক্রেতা এক মহিলা কী ভাবে তৈরি করলেন একটা হাসপাতাল? এত টাকাই বা পেলেন কোথা থেকে ?


স্থানীয় এক বয়ষ্ক মানুষের কাছে শোনা গেল হাসপাতাল তৈরীর ইতিহাস, সুভাষিনী দেবীর জন্ম বাংলাদেশে হলেও পরবর্তী সময়ে চলে আসেন এপারে। বিয়ে হয় মাত্র ১২ বছর বয়সে । স্বামী সাধন মিস্ত্রি ছিলেন দিনমজুর ২৩ বছর বয়সে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে স্বামী মারা যান। ১১ বছরের দাম্পত্য জীবনে কোলে এসেছিল চার সন্তান। মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে যায় ৪ নাবালক সন্তানকে নিয়ে অথৈয় জলে পড়েন তিনি, কি করে মানুষ করবেন তাদের। এই প্রতিকুল পরিস্থিতেও ভেঙে পড়েনি সুভাষিনী দেবী। দৃঢ় সংকল্প নিয়েছিলেন চোখের সামনে আর কোনো ব্যক্তিকে যাতে প্রান খোয়াতে না হয়। মনে মনে পন করলেন হাসপাতাল গড়বেন। সেই হাসপাতালে গরিবের চিকিৎসা হবে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায়।




প্রতিবেশিদের কাথায় ‘‘লোকের বাড়ি কাজ করা দিয়ে ওঁর যুদ্ধ শুরু। লোকের এঁটো খেতেন। বাচ্চাদের নিয়ে ধাপার মাঠে ময়লা ঘেঁটে কয়লা তুলে বিক্রি করতেন। সবশেষে চৌবাগা থেকে ভোর তিনটেয় ঠেলাগাড়িতে আনাজ তুলে কোলের বাচ্চাটাকে তার উপর বসিয়ে ঠেলে চার নম্বর ব্রিজের তলার বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা শুরু করেন।’’ বাকি ছেলেমেয়েদের দিয়েছিলেন অনাথ আশ্রমে। মাথা নত করেছেন সারা জীবন মাথা উঁচু করে বাঁচবেন বলে। যে টুকু উপার্জন করেছেন, সিংহ ভাগটাই দান করেছেন হাসপাতাল তৈরীর কাজে।

সালটা ১৯৯৩, জমানো টাকায় হাসপাতাল বানানোর জন্যে শহরের বাইরে ১০ হাজার টাকা দিয়ে  ১ বিঘা জমি কিনে ফেলেন সুভাষিনী দেবী। জায়গাটি কলকাতার অনেক কাছাকাছি একটি গ্রামে হাঁস পুকুর। সবসময় সেই নীচু জায়গায় জল জমে থাকে। 
এক প্রতিবেশির কথায়, ‘‘প্রথম যে দিন পাড়ার লোকেদের ডেকে হাসপাতাল করবেন বলে উনি জানালেন, আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি। যে দিন দেখলাম ধান জমিতে কোমর জল ঠেলে মাথায় করে মাটি নিয়ে ফেলছেন তখন আমরা ভাবতে শুরু করলাম কিছু একটা করবেন উনি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘তখনই আশপাশের মানুষ, গ্রাম প্রধান সবাই একজোট হয়ে তৈরিকরা হল ট্রাস্ট। স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী তৈরি হল। সবাই সামর্থ মত টাকা দিল। এত কাদা ছিল যে, বাঁশের রণপা পরে হাসপাতাল তৈরির কাজ তদারকি করতে যেতাম আমরা। প্রথমে তৈরি হল আটচালা, সেখানেই চিকিতসা শুরু হল।’’ 




ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে পেতে আজ ৪৫ শয্যার হাসপাতাল, চিকিতসার সঙ্গে যুক্ত আছেন ২০ জন ডাক্তার এবং ৩২ জন নার্স। এখন আধময়লা শাড়ির ঘোমটাটা মাথায় টেনে বুড়িমা ঘুরে বেড়ান হাসপাতালের প্রতিটি ঘরে, রোগীদের কাছে। সেই মাকেই পদ্মশ্রী সম্মান তুলে দিলেন রাষ্ট্রপতি। 






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রয়োজনে অবশ্যই কমেন্ট করুন, দয়াকরে কোন স্প্যাম লিঙ্ক কমেন্টে দেবেন না।